Wednesday, January 30, 2019

মেট্রোরেল : শুভঙ্করের ফাঁকি


“মেট্রোরেল হয়ে ঢাকা শহরের যানজট কমবে”-এই কথাটা সরকারের অনেক মন্ত্রী-আমলারা বলেছে। তারা এক্ষেত্রে দুটি বাক্য ব্যবহার করেছে-
১) মাত্র ৩৭ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে।
২) এক সাথে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে ।
(https://bit.ly/2DyXY51)

প্রথম কথাটি শুনে যদি আপনি মনে করেন, ট্রেনে উঠবেন আর ৩৭ মিনিট পর উত্তরা থেকে মতিঝিল চলে আসবেন, তবে কিন্তু ভুল করবেন। কারণ-
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশন আছে, আর প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামবে ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড পর পর (https://bit.ly/2Sa8fN2), সে হিসেবেও কিন্তু ১৫টি স্টেশন যেতে সময় লাগবে প্রায় ৫৩ মিনিট। আর যদি প্রতি স্টেশনে কমপক্ষে গড়ে ১ মিনিট দাড়ায় (৪-৫ মিনিট হওয়াও অস্বাভাবিক নয়), তাহলে আরো ১৫ মিনিট যোগ করে ১ ঘণ্টা ৮ মিনিট।
আর ট্রেন যদি দ্রুত চলতে পারে, তবে হয়ত দ্রুত যাওয়া সম্ভব। ফ্লাইওভারগুলোতে কিন্তু যানবাহন আস্তে চলতে বলা হয়, ফ্লাইওভারে গতি দ্রুত করলে তার ক্ষতি হয়। তেহরানে মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ গতি ১০০, কিন্তু চলে সর্বোচ্চ ৩৭ কিলো গতিতে টানে। কারণ ৪-৫শ’ টন ওজনের একটি মেট্রো ১০০কিলো গতিতে টেনে নিলে দ্রুত ফ্লাইওভারে ফাটল ধরবে। তাই মেট্রোরেলের গতি কমিয়ে আনতে হয়। এছাড়া স্পট কাছাকাছি হওয়ায় এত বেশি গতি তোলাও সম্ভব না। এক্ষেত্রে মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ গতি হতে পারে ৩০ কিলো বা তার নিচে হতে পারে। তাই মাত্র ৩৭ মিনিটে আসা যাবে, এ কথাটা আসলে ভুল এবং ১ ঘন্টার বেশি সময় লাগতে পারে।
(১ ঘন্টা ৮ মিনিট হওয়ার শর্ত: *যদি সকল রেলগাড়ি ভালো থাকে, *লাইনে কোন সমস্যা না থাকে, *যদি কোন স্টেশনে কোন সমস্যা না হয়, কারণ একটি রেলগাড়ি স্টেশন না ছাড়লে অন্যটি ঢুকতে পারবে না এবং *যদি সকল স্টেশনে যাত্রীরা নিয়মশৃঙ্খলা মেনে উঠতে পারে)

দ্বিতীয় কথাটার হিসেব মিলাচ্ছি।
সংবাদ হিসেবে মোট ১৪ জোড়া মেট্রোরেল চলবে (https://bit.ly/2Hx0I72)। যদিও বলা হচ্ছে, প্রতি মেট্রোরেল বসে ও দাড়িয়ে দেড় হাজারের উপরে যাত্রী নিতে পারবে। কিন্তু কথা হলো মাথার উপর দিয়ে চলা প্রতি মেট্রোতে কতগুলো করে বগি থাকবে ? প্রতি বগিতে বসে দাড়িয়ে যেতে পারে প্রায় দেড়শ’ যাত্রী। প্রতি বগির ওজন হবে ৭০ থেকে ১০০ টন। তাহলে মাথার উপরে একটি ট্রেন সর্বোচ্চ কতগুলো বগি বহন করতে পারবে ? এটা ঠিক মাটির নিচে সাবওয়েতে প্রচুর যাত্রী নেয়া যায়, কিন্তু ফ্লাইওভারের উপরে মেট্রোতে কিন্তু এত ওজন বহন করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে তিনটির বগি বহন করলে দাড়িয়ে বসে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪শ’ জন যাত্রী যেতে পারবে। যদিও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে দেড় হাজার যাত্রী এক সাথে যেতে পারবে, তাহলে কিন্তু প্রতি গাড়িতে কমপক্ষ ১০টি বগি বহণ করতে হবে। তখন ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী যেতে পারবে। তাইওয়ানের মত প্রযুক্তিতে উন্নত রাষ্ট্রে মেট্রোরেল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ হাজার ক্যাপাসিটি দেয়, সেখানে বাংলাদেশ কিভাবে ৬০ হাজার ক্যাপাসিটির ঘোষণা দিলো তা আমার মাথায় আসে না। পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতেরে চেন্নাইয়ে প্রতি মেট্রোতে দেখলাম ৩টি করে বগি। বাংলাদেশও এর থেকে বেশি দিতে পারবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে ১৪ জোড়া ট্রেন সর্বোচ্চ ১২,৬০০ যাত্রী বহণ করতে পারবে, ৬০ হাজার চিন্তা করা স্বপ্নেও সম্ভব না।

এতো গেলো কোন সমস্যা না হলে সহজ হিসেব, এবার আসুন দেখি সমস্যা হলে কি হবে –
ক) প্রতি স্টেশনে ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের দাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু যাত্রী উঠতে-নামতে কিংবা গাড়ি ছাড়তে যদি এর বেশি সময় লাগবে, তবে ৩ মিনিট ৫ মিনিট বা ১০ মিনিট হতে পারে। তখন উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌছাতে ১ ঘন্টা ৩৭ মিনিটের স্থানে দুই আড়াই ঘন্টা খুব স্বাভাবিক।
খ) মোট ২৮টি রেল যদি সুস্থ থাকে তবে ১২ হাজার যাত্রী চলাচল করবে। কিছু আগে দেখলাম বিআরটিসি কিছু ভালো ভলবো বাস সার্ভিসিং এর অভাবে অকেজো করে ফেলেছে (https://youtu.be/Zs_o8pqUjGo)। সরকার যেখানে সামান্য বাস সার্ভিসিং ঠিক রাখতে পারে না, সেখানে মেট্রোরেলগুলো সুস্থ রাখবে কিভাবে ? ১ বছরের মধ্যে ২৮টা মেট্রোরেলের মধ্যে যদি ৭টা নিয়মিত চলে তবে ঢাকাবাসীকে আনন্দিত হওয়া উচিত। মনে রাখবেন, তখন কিন্তু ১২ হাজার যাত্রী ৩ হাজারে নেমে আসবে। অর্থাৎ মুখে বলেছে ৬০ হাজার, কিন্তু ১ বছরে নেমে হবে ৩ হাজার।
গ) রেল নষ্ট হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ যদি রাস্তায় কোন রেল নষ্ট হয়ে থেমে যায় তখন দেখা যাবে পুরো রেল ব্যবস্থা থেমে যাবে। আর এটা রাস্তা নয়, ফ্লাইওভারের উপরে। ইচ্ছে হলেই কেউ স্টেশন ছাড়া নামতে পারবে না। ফলে কোন রেল নষ্ট হলে হৈচৈ পড়ে যাবে, কারণ মানুষ উপরে আটকা পড়ে থাকবে।
ঘ) দেশে রেললাইন স্থলে হলেও তার খুব বেহাল অবস্থা। কোন স্থানে লাইনে সমস্যা হলে জনগণ জানায়, রেল বিভাগের খবর নেয়ার সময় কোথায় ? মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে লাইন হবে উপরে, আপনার কি মনে হয় সরকার প্রতিদিন এই ১২-১৪ কিলো লম্বা লাইন টেস্ট করবে ? ফলে কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটলে রেলের বগি শুধু উপর থেকেই পড়বে না, জনগণের ফেইথ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে।
ঙ) মেট্রোরেলের জন্য যে ১৬টি স্টেশন করা হবে, সেগুলো নুতন করে যানজটের জন্ম দিবে। এমন হবে, শেষে ৩ হাজার যাত্রী বহণ করতে ৩০ লক্ষ লোকের যাতায়তের সমস্যা তৈরী করবে। সরকার এসব স্টেশনে যাত্রী উঠতে অটো সিড়ির জন্য ঋণ নিয়ে খরচ করছে। কিন্তু এই অটো সিড়ি কতদিন চলবে তা প্রশ্নের বিষয়। তাছাড়া খুব কম যায়গায় মধ্যে যাত্রী উঠতে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটা খুব স্বাভাবিক।

এবার আসুন, মেট্রোরেলের কিছু আনুসাঙ্গিক দিক আলোচনা করি-
- জাপান থেকে ঋণ এনে, দেশকে ঋণের মধ্যে ফেলে ডুবিয়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই মেট্রোরেল কতটুকু যুক্তিসঙ্গত ? এই ঋণের টাকা তো জনগণকে ট্যাক্স-ভর্তুকি আর চাল-ডালের অতিরিক্ত দাম দিয়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
- স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে, কোন একটি প্রজেক্ট পরীক্ষামূলক করে তার ভালো মন্দ যাচাই করে তারপর সেটাকে হ্রাস-বৃদ্ধি করা। কিন্তু সরকার ১টি মেট্রোরেলের বাস্তবতা না দেখেই আরএসটিপি প্রজেক্টের আন্ডারে আরো ৪টি মেট্রোরেল বানানোর ঘোষণা দিয়েছে। (https://bit.ly/2Hx0MDK)
- ঋণ নিলেই শুধু হবে না, ঋণের টাকা সুদ আসলে পরিশোধ করতে হবে। এ বছর বাজেটে প্রায় ৫০ হাজার কোটি ছিলো শুধু ঋণের সুদ পরিশোধ। উল্লেখ গত কয়েকদিন আগে মেট্রোরেল প্রজেক্টের ঋণ দাতা জাপান সরকারের জাইকা তাদের ঋণের সুদ ৬ গুন বৃদ্ধি করে, যদি দৈনিক যুগান্তরের খবর সরকারের পক্ষ থেকে তা কঠিনভাবে সেন্সর করা হয়।(https://bit.ly/2Wk9Yyr)

- বর্তমানে মেট্রোরেল বানানোর কারণে প্রচুর যানজট তৈরী হচ্ছে। যে প্রজেক্টে ১ বছর পর মাত্র ৩ হাজার লোক যাতায়ত করবে, সেটার জন্য এখন প্রতিদিন যানজটে ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়া এবং ভবিষ্যতেও সরু রাস্তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ যানজটে আটকে থাকার দায় কে নেবে ? এর বদলে ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা শহরকে যদি বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিতো সরকার তবে মানুষ কমে অটোমেটিক যানজট হ্রাস পেতো।

আমি নিশ্চিত, হাজার কোটি টাকা খরচ করা মেট্রোরেল প্রকল্প খুব শিঘ্রই একটি বাতিল প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। হয় মেট্রোর ফ্লাইওভারগুলো তখন কুকুর বিড়ালের অভয়ারণ্য হবে, গাজিয়ে উঠবে গাছ, অথবা যদি ২-৪টি হেলে দুলে চলেও, সেটা হবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিরাপদ ডেটিংস্থল, কারণ একমাত্র তারাই সময় নিয়ে চিন্তা করবে না, ২ ঘণ্টার যায়গায় ৪ ঘণ্টা হলেও তাদের কোন সমস্যা-ই নেই।


===============================
আমার মূল পেইজ- Noyon chatterjee 5
(https://www.facebook.com/noyonchatterjee5)
পেইজ কোড- 249163178818686
------------------------------------------------------------------
আমার ব্যাকআপ পেইজ- Noyon Chatterjee 6
(https://www.facebook.com/Noyon-Chatterjee-6-202647270140320/)
------------------------------------------------------------------------------------------------

0 comments:

Post a Comment